সেই ছোট থেকেই যখন জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা গাইতাম। প্রথম প্রথম স্যারগণ যখন সামনে পাঠিয়ে দিত তখন ব্যাপক লজ্জা পেতাম। ধীরে ধীরে সেই ধকল কাটিয়ে উঠি। স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যেতে সহপাঠীদের সাথে হত জাতীয় সংগীতের ভাব। তখন মনের ভিতর অন্য রকম শিহরণ কাজ করতো। গুনগুন করতাম ঐতিহাসিক কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।

শিশুদের নিয়ে লেখা বিভিন্ন কবিতা গল্পগুলোকে দরদ দিয়ে লিখেছেন। তার লেখার প্রসংশা বিশ্বব্যাপী নন্দিত। এতক্ষণে হয়তো বুঝতে পারছেন কাকে নিয়ে কথাগুলো বলছি। তিনি আর কেউ নন তিনি হচ্ছেন, আমাদের বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার লেখা পড়ে, গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি। কাজ করতো মনে আলাদা ভালবাসা। তখন থেকেই মনে মনে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখতে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছি।

সুদূর জামালপুর জেলা থেকে
পুরো ভবনটি কবির বিভিন্ন বয়সের ছবি এবং তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র ও শিল্পকর্মে সমৃদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে- চিত্রকর্ম, কবিতা, হাতে লেখা চিঠি, পানি পরিস্কার যন্ত্র, সিন্দুক, ঘাস কাটার যন্ত্র, মাটি মসৃণ করার যন্ত্র, ছিন্নপত্র, পালকি, কাঠের চেয়ার, টি-টেবিল, খাট, সোফাসেট, হলরুম, আরাম চেয়ার, পালংক, আলনা, আলমারি, স্পিডবোট, পদ্মা বোট ইত্যাদি।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ভর্তি হওয়ার সুবাদে সে সুযোগ হয়েছে আমার। ইচ্ছা পূরণে বের হয়ে গেলাম। পৌঁছে গেলাম সেখানে। যাত্রা পথে দুই দিকে ফসলের খেত, গাছপালা। গ্রামের এমন দৃশ্য ছিল সবচেয়ে সুন্দর। আর মনের এ মুগ্ধতা লিখে প্রকাশের মতো নয়। প্রধান ফটকে প্রবেশ করতেই কবির বিখ্যাত দুটি কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি ও সোনার তরী নামে দুটি ভবন। ভেতরে প্রবেশ করে সামনেই চোখে পড়বে এই পর্যটনস্থলের মূল কেন্দ্রবিন্দু কুঠিবাড়ি। দ্বিতল ভবনবিশিষ্ট এই বাড়ির নির্মাণশৈলী যে কারও নজর কাড়তে বাধ্য। এখানে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির ১৬টি কক্ষ। পুরো ভবনটি কবির বিভিন্ন বয়সের ছবি এবং তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র ও শিল্পকর্মে সমৃদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে- চিত্রকর্ম, কবিতা, হাতে লেখা চিঠি, পানি পরিস্কার যন্ত্র, সিন্দুক, ঘাস কাটার যন্ত্র, মাটি মসৃণ করার যন্ত্র, ছিন্নপত্র, পালকি, কাঠের চেয়ার, টি-টেবিল, খাট, সোফাসেট, হলরুম, আরাম চেয়ার, পালংক, আলনা, আলমারি, স্পিডবোট, পদ্মা বোট ইত্যাদি।

দোতলায় রয়েছে একটি নজরকাড়া বারান্দা, যেখানে বসে কবি লিখতেন। দেয়ালে টাঙানো রবি ঠাকুরের একটি লেখা মনকে মনঃপুত করেছে। লেখাটি ‘অধিক করিনা আশা, কিসের বিষাদ, জনমেছি দুদিনের তরে যাহা মনে আসে নেই আপনার মনে গান গাই আনন্দের ভবে।’ এরকম অসংখ্য লেখা আবেগঘন করে তোলে।কুঠিবাড়িটি কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহে ১১ একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ১১ একরের প্রতিটি পরতে পরতে যেন কবির স্মৃতি জড়িয়ে আছে! এখানে রয়েছে- একটি বিশাল আম বাগান, দুটো পুকুর, রবীন্দ্র মঞ্চ, পাঠশালা, একটি ফুলের বাগান ও বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষরাজি। বাড়ির একপাশে আছে ছোট্ট একটি গ্রন্থাগার, যেখানে রয়েছে কবির বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থের সংগ্রহ। পুরো কুঠিবাড়ির চারপাশ ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা।

রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে। সেখানে বসে রবীন্দ্রনাথ যেসব গান-কবিতা লিখেছেন, তার মধ্যে কুঠিবাড়ির পাশে বকুলতলার ঘাটে বসে লেখা ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’সহ অসংখ্য লেখা।

রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে। সেখানে বসে রবীন্দ্রনাথ যেসব গান-কবিতা লিখেছেন, তার মধ্যে কুঠিবাড়ির পাশে বকুলতলার ঘাটে বসে লেখা ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’সহ অসংখ্য লেখা। কবিগুরু শিলাইদহে ছিলেন ১৯২২ সাল পর্যন্ত। এ সময়কালে জগদীশচন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদারসহ তৎকালীন বঙ্গের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও কবি-সাহিত্যিক এখানে এসেছেন। সুদীর্ঘ ৩০ বছর এখানে অবস্থানকালে তিনি সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর বাড়িটি সংরক্ষণ করছে। সরকারি উদ্যোগে এখানে ‘ঠাকুর স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভবনটি এখন জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে ঘোরাঘুরি করলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ১০০ বছর আগে ফিরে যেতে বাধ্য।

লেখক: আর এম রিফাত, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়